০১। পৃথিবীতে যত প্রকার ধর্ম্ম প্রণালী প্রচলিত আছে, সমুদায় ধর্ম্ম প্রণালী আপাততঃ পরস্পর বিরুদ্ধবৎ প্রতীয়মান হইলেও বস্তুতঃ পরস্পর বিরুদ্ধ নহে, ইহা সাধারণ জনগণকে পরিজ্ঞাপিত করা সত্যধৰ্ম্ম প্রচারের প্রথম উদ্দেশ্য।
০২। উল্লিখিত ধর্ম্ম প্রণালী সমূহ অবলম্বন করিয়া অনেক অনেক মহাত্মা সিদ্ধ হইয়া গিয়াছেন বটে কিন্ত এই পরিবর্তনশীল জগতে শরীরের ন্যয় মনের অবস্থারও বংশ পরম্পরায় পরিবর্তন সাধন হইতেছে। সম্প্রতি মনুষ্যের দেহের ও অন্তকরণের যেরূপ অবস্থা তাহাতে তাহারা আর পূৰ্বানুষ্ঠিত কঠোর সাধনা করিয়া প্রায়শঃ সিদ্ধিলাভে সমর্থ নহে। এজন্য এই বৰ্তমান সময় আমাদিগের গুরুদেব যেরূপ স্বল্পয়াস-সাধ্য সাধনার উপদেশ দিয়াছেন, তাহা সর্ব সাধারণের ক্লেশ রাশি নিবারণাৰ্থ সৰ্ব্বত্র। প্রকাশিতকরা সত্যধর্ম্ম প্রচারের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য।
০৩। দেবদেবীগণ পূৰ্বেও যেমন ছিলেন, এখনও তেমনি আছেন, পূর্বে তাঁহাদিগের অর্চনা করিয়া যেরূপফল পাইত, এখনও প্রকৃত পূজা করিতে পারিলে তদ্রূপ ফলই প্রাপ্ত হওয়া যায়। কিন্তু পূজা পদ্ধতি প্রায় পূৰ্ব্ববৎথাকিলেও উহার অন্তর্গত অতি প্রধান ও গুহ্য দুইচারিটী কথা স্থানে স্থানে নাই, বোধ করি পূর্ধ্বতন পূজকগণ স্বীয় গৌরব রক্ষার্থ ঐগুলি গ্রন্থ হইতে তুলিয়া ফেলাইয়া দিয়াছিলেন, কারণতাহা হইলে অন্যে ঐ পুস্তক দেখিয়া পূজা করিয়া আর ফল পাইবে না, কিন্তু তাঁহারা গুপ্ত অংশের পরিজ্ঞান সিদ্ধির ফল পাইতে পারিবেন। এইরূপ যে সকল অংশ গুপ্ত হইয়াছে, তাহা পুনঃ প্রচারিত করা সত্যধৰ্ম্মের তৃতীয় উদ্দেশ্য।
০৪। কি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণবাদি ধৰ্ম্ম, কি বৌদ্ধ ধৰ্ম্ম, কি ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমান ধৰ্ম্ম-সকল ধৰ্ম্মেই ঐরূপ কতগুলি কথা আছে, যাহার অর্থ আপাততঃ কিছুই বুঝা যায় না, অথবা অতিশয় কুৎসিৎ বলিয়া জানা যায়, কিন্ত ঐ সমস্তের যে অতি উৎকৃষ্ট অর্থ আছে, তাহা না জানাতে ঐ সকল ধর্মাবলম্বীরা স্ব স্ব ধর্মের প্রতি ক্রমশঃ বীত রাগ হইতেছেন, একারণ তাহাদিগকে দৃতর রাখা এবং উল্লিখিত অসত্য সংকলনের অপসরণ পূৰ্ব্বক সত্য প্রকাশ সত্য ধৰ্ম্মের চতুর্থ উদ্দেশ্য।
(৫) কোন একজন প্রকৃত ধর্ম্মার্থী কখনই হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি সকল ধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া পরিচিত হইতে পারেন না, অথচ যিনি প্রকৃতরূপে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করেন, তিনি ঐ সকল ধর্ম্মের কোনটীরই বিরোধী নহেন। সুতরাং তাঁহাকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, আপনি কোন ধর্মাবলম্বী, তবে তিনি কোনও প্রচলিত ধর্মের নাম করিতে পারেন না, কেননা তৎসমুদায়ই বর্ত্তমান সময়ে সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে নিবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া সৰ্ব্বধৰ্ম্ম মৰ্ম্মভাব অপূরিত, একারণ তাঁহাকে বলিতে বাধা হইতে হয়, যে, যে ধৰ্ম্ম সত্য অর্থাৎ যথার্থ বিষয় সমূহে পরিপূর্ণ, যে ধৰ্ম্ম সত্য অর্থাৎ নিত্যকাল অনন্তকাল বিদ্যমান ছিল, আছে ও থাকিবে, এবং যে ধৰ্ম্ম সত্য অর্থাৎ সত্য স্বরূপ পরমপিতার একমাত্র অভিপ্রেত, আমি সেই ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছি। এক্ষণেবিবেচনা করিয়া দেখউল্লিখিত ধৰ্ম্মের কোনও একটী নাম হইতে পারে না। কিন্তু যেমন জগদীশ্বর নিরুপাধি হইলেও ভক্তগণতাঁহাকে নানাবিধ নামে আখ্যাইত করিয়াছেন তদ্রূপ উল্লিখিত ধৰ্ম্মেরও নানারূপ নামকরণ হইয়াছে। কিন্তু যতগুলি নাম জগতে প্রচালিত হইয়াছে কোনটাই ব্যাপক নহে, সকল গুলি ব্যাপ্য, কেবল “ব্রাহ্মধর্ম্ম” এই নামটী ব্যাপক, কিন্তু উক্ত নামটী ধর্ম্মের মর্ম্ম প্রকাশক না হইয়া কেবল ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের লক্ষ্যার্থের প্রকাশক হইয়াছে, এজন্য ঐ নামটীকেও সৰ্ব্বাঙ্গ সম্পন্ন বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। মনে কর, একজন জিজ্ঞাসা করিলেন যে মহাভারতের রচয়িতা কে, ইহাতে যদি কেহবলে যে “পরাশরের পুত্র,” তবে উহা অসঙ্গত হইল না বটে, কিন্তু প্রণেতার প্রকৃত নাম জানা গেল না, কেবল তৎপরিবর্ত্তে তাঁহার একটী মাত্র বিষয়ের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গেল। এইরূপ ব্রহ্মধৰ্ম্ম বলিলে বুঝা যায় যে উহা ঈশ্বরবাদপূর্ণ ধৰ্ম্ম, এই মাত্র, কিন্তু অত্যাবশ্যক পূর্বোক্ত ত্রিবিধ অর্থ বুঝায় না। এই সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া পারলৌকিক মহাত্মারা এই বিশ্বব্যাপী-সৰ্ব্বধৰ্ম্ম গর্ভ সৰ্ব্বাপেক্ষা ব্যাপকতম “সত্যধর্ম্ম” এই নাম নির্দেশ করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, সংস্কৃত ভাষা পার্থিব সমস্ত ভাষা অপেক্ষা ব্যাপক বলিয়া ইহার, “সত্য” শব্দ যাদৃশ ভাব প্রকাশক, অন্য সমস্ত ভাষায় তাদৃশ ব্যাপক শব্দের প্রচলন নাই। তথাপি অংশতঃ যাহা আছে তাহা অবলম্বন করিলে পূৰ্ব্বে পূর্ব্বেও এইরূপ নামই প্রদত্ত হইয়াছিল যথা— খৃষ্ট প্রচারিত ধৰ্ম্ম ‘ট্রু রিলিজেন’’অর্থাৎ সত্যধৰ্ম্ম নামে বিখ্যাত।