সত্য-ধৰ্ম্ম।
মুখবন্ধ।
আহা। জগতের আজ কি শুভদিন! কি আনন্দময় দিন!! কি অমৃতময় দিন!!! কোটি কোটি মানবের উদ্ধারের পথ আজ প্রকাশিত হইল। পাপপূর্ণ জগৎ আজ পরিত্রাণের পথ প্রাপ্ত হইতে চলিল!! ইহা অপেক্ষা সুখের-আনন্দের দিন আর কি হইতে পারে??? হে মানবগণ! তোমরা প্রস্তুত হও; তোমাদিগের পরিত্রাণ করিতে পরম পিতা আজ উদ্যত হইয়াছেন।
সত্যধর্ম্মের যথোযথ বিবরণ এই গ্রন্থের প্রকরণবিশেষে বিবৃত হইবে। মুখবন্ধে এইমাত্র বলা যাইতেছে যে, নিরাকার (১) (নিরাকার বলিলেও ঐশ্বরিক ভাব কিছুই বুঝা যায় না। একারণ "উপাসনা" নামক গ্রন্থে ঈশ্বরের স্বরূপ পাঠ কর)। অদ্বিতীয়, সর্ব্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান, অনাদি-অনন্ত, অসীম, অনন্ত-গুণ-নিধান পরম পিতার উপাসনা করিবে। মনুষ্য স্ব-কৃত কৰ্ম্মানুসারে আত্মপ্রসাদ বা আত্মগ্লানি ভোগ করে, দেহ-ত্যাগান্তে পরলোকে অবস্থিতি করে,আর পরলোক-গতদিগের মধ্যে কতকগুলি আত্মা পুনরায় জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন, কেহ কেহ আর জন্মগ্রহণ করেন না। এই বিশুদ্ধ ধর্ম্মের মতে সাকার উপাসনা নাই (২), যোগ-সাধন নাই,(সাকারের উপাসনা নাই, কিন্তু অর্চ্চনা আছে। ইহার বিস্তৃত বিবরণ "উপাসনা" নামক গ্রন্থে দেখ)। জাতিভেদ নাই, এবং নির্ব্বাণ (ঈশ্বরে লীন হওয়া) নাই।(স্ব-প্রযত্নে যে কেহ লীন হইতে পারে না ইহাই ইহার উদ্দেশ্য)। ঈশ্বরেচ্ছা হইলে সকলেই তাঁহাতে লীন হইতে পারে। (৩)। ইহার মতে গুণসাধন সর্ব্বপ্রধান কার্য্য। সুতরাং ঈশ্বরোপাসনা ও গুণের অভ্যাস একমাত্র কার্য্য। এই ধর্মানুসারে জগতের সমস্ত নর নারীকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করিতে হয়, এই অভেদ ভাব অবশেষে সমস্ত চেতন পদার্থে পরিণত হয়। এই ধৰ্ম্ম অবলম্বনার্থে হিন্দু শাস্ত্রোক্ত চতুর্ব্বিধ আশ্রমের বিশেষ কোন আশ্রম প্রয়োজনীয় নহে, সকল আশ্রমীই ইহা অবলম্বন করিতে পারেন। সত্যধর্ম্মের আশ্রম হৃদয়, যাহাতে পরমাত্মা আসীন থাকেন। আশ্রম গ্রহণ কর বলিলে বুঝিতে হইবে যে, হৃদয়ে জগদীশ্বরকে স্থান দেও। যে নিরাশ্রমী, তাহার হৃদয় নাই, তাহাতে পরমাত্মা বসিতে পারেন না, কেবল উপরি উপরি রক্ষা করেন, কিন্তু পরিত্যাগ করেন না।
সম্প্রতি বক্তব্য এই-সত্যধৰ্ম্ম যে পৃথিবীর সমস্ত প্রচলিত ধর্ম অপেক্ষা সত্য ও উৎকৃষ্টতম, তাহা প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত হইবে। এক্ষণে কেবল উহা যে অন্যান্য প্রচলিত ধৰ্ম্ম অপেক্ষা বিভিন্ন, তাহাই প্রদর্শিত হইতেছে।
১। সত্যধর্ম্মে সাকার উপাসনা নাই, সুতরাং সমস্ত সাকারবাদপূর্ণ ধৰ্ম্ম হইতে ইহা বিভিন্ন।
২। ইহাতে হঠযোগাদির ন্যায় কোনও প্রকার যোগ সাধনা নাই, এবং পদ্মাসনাদির ন্যায় কোনও প্রকার আসন-সিদ্ধিও নাই, সুতরাং ইহা সমস্ত যোগ সাধন ধৰ্ম্ম ও আসনসাধন ধৰ্ম্ম হইতে বিভিন্ন।
৩। নিরাকারবাদী বেদান্ত পরিপাদ্য ধৰ্ম্ম ও স্বল্প কালপ্রচলিত ব্রাহ্ম ধৰ্ম্ম হইতেও ইহা বিভিন্ন। কারণ বেদান্তের অতি ভীষণ অহঙ্কারময় অন্যায্য "সোহহং” প্রভৃতি ভাবেও ইহা দূষিত নহে, এবং ব্রাহ্ম ধর্মের ন্যায় “একবার মাত্র মনুষ্য জন্ম গ্রহণ করে” ইত্যাদি অদূরদর্শিতায়ও ইহা মহত্ত্ব শূন্য নহে।
৪। পরম পিতার সহিত "পুত্র ও পবিত্র আত্মার” অভেদজ্ঞান প্রযুক্ত খ্রীষ্ট্রীয় ধৰ্ম্ম এবং পুনর্জন্ম অস্বীকার প্রভৃতি নিবন্ধন খ্রীষ্ট্রীয় ও মহম্মদীয় ধৰ্ম্ম ইহা হইতে বিভিন্ন। মহম্মদীয় ধর্ম্মে নরহত্যারও বিধি দেয়, সত্যধৰ্ম্ম হত নরকে জীবন দান করেন।
৫। বৌদ্ধেরা যদিও পরম সত্য অহিংসা বিষয়ে সত্যধর্মের কিঞ্চিৎ নিকটস্থিত, কিন্তু ঈশ্বরজ্ঞান, পরলোক ও মুক্তি প্রভৃতির পরিস্ফুট বোধ এবং উপাসনা প্রভৃতি বিষয়ে, অত্যন্ত দূরগত ও নিম্নস্থিত। সুতরাং সত্যধৰ্ম্ম উহা অপেক্ষাও বিভিন্ন।
৬। সত্যধৰ্ম্ম আধুনিক "থিয়জফিষ্ট-ধৰ্ম্ম” হইতেও বিভিন্ন। কারণ পরলোক ও পুনর্জন্মাদি বিষয়ে ইহার সহিত ঐক্য নাই। আর থিয়জফিষ্ট-ধৰ্ম্মে কোন কোন গুণের উন্নতির বিধি থাকিলেও, উহা "সোহহং” এই ভীষণতম অহঙ্কারপূর্ণ ভাবে কলুষিত।
৭। সত্যধৰ্ম্ম সাধারণ আত্মাকর্ষণ (আমেরিকাদি মহাদেশে প্রচলিত স্পিরিচুয়ালিষ্ট) ধৰ্ম্ম অপেক্ষাও বিভিন্ন। কারণ ঐ ধর্মে অত্যুন্নত মহাত্মাদিগের উপদেশ নাই, কেবল কতকগুলি বৈজ্ঞানিক বিষয়ের সাদৃশ্য-প্রদর্শন মাত্র আছে।
উপরে যাহা যাহা লিখিত হইল, তাহাতে ইহা বিশদরূপেই প্রদর্শিত হইয়াছে যে, "সত্য-ধৰ্ম্ম” অন্যান্য প্রচলিত ধৰ্ম্ম হইতে বিভিন্ন। ইহার সর্ব্বোৎকৃষ্টতার ও সত্যতার বিষয়ও আনুষঙ্গিক কিছু কিছু লিখিত হইয়াছে বটে, কিন্তু তদ্বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ ১ম পরিচ্ছেদে লিখিত হইবে।
এক্ষণে ধৰ্ম্মার্থী সহজেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, যদি তোমাদিগের এ ধর্ম অন্য কোনও প্রচলিত ধৰ্ম্মতুল্য অকিঞ্চিৎকর নহে, তবে তোমরা ইহা-এই অমূল্য রত্ন কিরূপে কোথা হইতে পাইয়াছ? এই প্রশ্নের উত্তরদান এই মুখবন্ধের আর একটি উদ্দেশ্য।
এক্ষণে বক্তব্য এই যে, আমরা আত্মাকর্ষণরূপ উৎকৃষ্ট উপায় দ্বারা পারলৌকিক মহাত্মাদিগের নিকট হইতে এই ধৰ্ম্ম প্রাপ্ত হইয়াছি।* (যে সকল পারলৌকিক আত্মারা অনন্তগুণধাম পরমপিতার সান্নিধ্যনিবন্ধন অতুল আত্মপ্রসাদ-সাগরে ভাসমান, তাঁহাদিগকে পারলৌকিক মহাত্মা কহে)। যেমন প্রদীপ হইতে যে আলোক প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা সামান্য ও সহজে নির্ব্বাণ হয়, কিন্তু সূর্যের আলোক বিশ্বব্যাপী ও অনির্ব্বাপণীয়, তদ্রূপ কালে জগতের সমস্ত ধম্মার্থীর হৃদয় হইতে অন্যান্য ধর্মপ্রদীপ (যাহাও এই সত্য ধর্ম্মের অংশের কণিকা স্বরূপ) নির্ব্বাপিত হইয়া দূরীকৃত হইবে; এবং সত্যধর্মরূপ মহা জ্যোতিঃ চিরবিরাজিত থাকিবে।
ওঁং
0 মন্তব্যসমূহ